হানা দিয়েছে অ্যাডেনো ভাইরাস। একরত্তি শিশুদের ওপরই তার বেশি চোখ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত ১০টি শিশু মারা গিয়েছে এই অ্যাডেনো ভাইরাসের প্রকোপে। গত দুই মাসে প্রায় ৫০-৬০ টি শিশু অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছে রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে। ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ (Institute of Child Health)- এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অ্যাডেনো ভাইরাসের কারণে অসুস্থ হয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে অন্তত ১১টি শিশু; যাদের মধ্যে পাঁচজন রয়েছে ভেন্টিলেশনে, অবস্থা সঙ্কটজনক। Adenovirus infection in children in Bangla.
অন্যান্য নামী দামি হাসপাতালের আই সি ইউগুলিতেও জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে মা-বাবাদের। কীভাবে বাঁচাবেন বাচ্চাকে এই অ্যাডেনো দানোর হাত থেকে; সেই চিন্তাতেই ঘুম ছুটেছে সব্বার। যেসমস্ত বাচ্চারা অ্যাডেনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারা খুব জলদিই সেরে ওঠো; এটাই একমাত্র প্রার্থনা বেবি ডেস্টিনেশনের। তোমাদের মা-বাবাদের পাশে সবসময় আছি আমরা। আর যেসব বাবা মারা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলি, ভয় পাবেন না এবং অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না। কী এই অ্যাডেনো ভাইরাস, কীই বা তার উপসর্গ, কীভাবে সাবধানে রাখবেন বাচ্চাকে; এই সমস্ত জানা থাকলে, আপনার সাহসও বাড়বে আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও বাড়বে। দেখে নিন একনজরে।
Adenovirus Infections: Causes, Symptoms, and Treatment in Bangla
কী এই এই অ্যাডেনো ভাইরাস? (What is Adenovirus?)
রোগ সৃষ্টিকারী অন্যান্য ভাইরাসের মতোই একটি ভাইরাস অ্যাডেনো ভাইরাস। অ্যাডেনো ভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয় এবং প্রচণ্ড সংক্রামক হয়ে থাকে। বড়দের তুলনায় ছোটদেরই এই অ্যাডেনো ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়। সাধারণত একদম বাচ্চা থেকে শুরু করে ৪/৫ বছর বয়সি বাচ্চা এবং খুব বয়স্কদের এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ এই রকম বয়সে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বলা হয়, যে একটি শিশু ১০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত কোনও না কোনও ভাবে একবার অন্তত যে কোনও প্রকারের অ্যাডেনো ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়। সাধারণত, এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ ফ্লু-র মতো উপসর্গ দেখা দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু একদম কচি বাচ্চা বা যেসব বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। এখনও কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ বা প্রতিষেধক টিকা নেই এই অ্যাডেনো ভাইরাসের সাথে লড়াই করার জন্য।
আক্রান্তের উপসর্গ (Symptoms of Adenovirus)
- জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা ও বসে যাওয়া।
- নাক থেকে জল পড়া।
- কানে ইনফেকশন।
- চোখ গোলাপি হয়ে যাওয়া (চোখ ওঠা বা জয়বাংলা বা কনজাংটিভাইটিস)
- ডাইরিয়া, বমি।
- মূত্রনালীতে সংক্রমণ।
- পেট ও অন্ত্রে সংক্রমণ।
এছাড়াও এই ভাইরাসের প্রভাবে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিস ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
Diagnosis, treatment, and prevention of adenovirus infection
কীভাবে সংক্রমিত হয় এই ভাইরাস? (Is it contagious?)
অ্যাডেনো ভাইরাস মারাত্মক রকমের সংক্রামক। যেসব জায়গায় অনেক বাচ্চা একসাথে থাকে; যেমন বাচ্চাদের স্কুল, চাইল্ড কেয়ার, বাচ্চাদের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, এমন কী হাসপাতাল থেকেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই ভাইরাস আক্রান্তের হাঁচি, কাশি, মল, থুতু, নোংরা ডায়াপার ইত্যাদি থেকে ছড়াতে পারে। আবার আক্রান্ত কোনও বাচ্চা সুইমিং পুলে পটি করে ফেললে, সেই দূষিত জল থেকেও এই ভাইরাস ছড়ায়। আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে বা তার গায়ে হাত দিলেও এই ভাইরাস সুস্থ বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অ্যাডেনো ভাইরাস আক্রান্তের খেলনা, তোয়ালে থেকেও সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত শিশুর নোংরা হাত থেকেও এই রোগ ছড়াতে পারে। একটি সুস্থ বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করার ২-১৪ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে থাকে।
ভাইরাস যে শরীরে ঢুকেছে, তা বুঝবেন কী করে? (How to diagnose Adenovirus?)
শিশুর শরীরে এই অ্যাডেনো ভাইরাস বাসা বেঁধেছে কি না জানতে নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলি করা হয়।
- রক্ত
- মূত্র
- মল
- মিউকাস
- বুকের এক্স-রে
চিকিৎসা পদ্ধতি (Treatment)
অ্যাডেনো ভাইরাসের কারণে হওয়া বেশির ভাগ রোগ নিজের থেকে সেরে যায়। কিন্তু যেসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে অসুস্থতা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষেধক নেই। রোগীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর জল ও তরল জাতীয় পদার্থ খাওয়া উচিত । রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। এই ভাইরাস থেকে হওয়া ইনফেকশন সারতে অনেক সময় দু’সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নেয়।
কীভাবে এড়াতে পারেন এই অ্যাডেনোর আক্রমণ (Precautions)
- বাচ্চার হাত কিছু সময় পরপর জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ধুইয়ে দিন। বাচ্চা খাবার খাওয়ার আগে, বাইরে থেকে এলে বা অনেকের সাথে খেলাধুলা করে এলে অতি অবশ্যই তার হাত-পা ধুইয়ে দেবেন।
- হাঁচি বা কাশির সময় বাচ্চাকে রুমাল ব্যবহার করা শেখান।
- বাচ্চা যদি কোনও খেলনা নিয়ে চাইল্ড কেয়ারে যায় সেই খেলনাটি কোনও জীবাণুনাশক তরল বা স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে দিন।
- শুধু বাচ্চাই না, পরিচ্ছন্ন থাকুন আপনিও। ডায়াপার বদলে দেওয়ার পর ভালো করে জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করুন।
- বাচ্চার জ্বর- সর্দির মতো উপসর্গ দেখা দিলে বা সে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চাইল্ড কেয়ার বা স্কুল পাঠাবেন না।
কিছু কথা মাথায় রাখুন (Few more tips to fight against adenovirus)
- বাচ্চাকে পরিষ্কার রাখুন।
- প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়ান।
- সচেতন নাগরিক হোন, যদি আপনার শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত, সে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে অন্যদের সাথে খেলতে দেবেন না বা স্কুলে পাঠাবেন না।
- বাচ্চাকে বাইরে নিয়ে গেলে মাস্ক ব্যবহার করতে দিন। এতে শুধু অ্যাডেনোই না, অনেক বায়ুবাহিত রোগের হাত থেকেও রক্ষা পাবে ও।
- বাচ্চার জ্বর যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি দিন আছে বা তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দেরি না করে ডাক্তার দেখান।
- উপরোক্ত উপসর্গগুলি যদি খুব বেড়ে যায়, তা হলে বাচ্চাকে আর বাড়িতে ফেলে রাখবেন না। ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং সমস্ত পরীক্ষা করান।
- ২-৩ মাসের বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চার শরীরে কোনও রকম এতটুকু বেভাব বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান।
- পরীক্ষা করিয়ে নিতে কোনও দোষ নেই। এতে আপনিও নিশ্চিন্ত আর যদি সংক্রমণ হয়েও থাকে, তা হলে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় কর্তব্য ঠিক করতে পারবেন ডাক্তার।
কলকাতার প্রসিদ্ধ শিশু বিশেষজ্ঞ (Child specialist) সুমনা কুন্দগ্রামীর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা। অ্যাডেনোর বাড়বাড়ন্তে বেশ চিন্তিতই শোনাল তাঁকে। বলছিলেন, ‘ভাইরাল ইনফেকশন যে কোনও সময় যে কোনও বাচ্চার হতে পারে। অ্যাডেনো-ও তেমনই। দুই বছরের নীচের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আশঙ্কাটা তুলনায় বেশি। কেননা ওদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাই ভাইরালঘটিত কিছু থেকে জটিলতা অনেকটাই বেড়ে যায়। ইউরিনের সাথে রক্তক্ষরণ হতে পারে। চোখে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ বছর তো বিশেষ করে নিউমোনিয়ার আক্রমণ হচ্ছে বেশি, কিছু কিছু বাচ্চাকে ভেন্টিলেশনেও রাখতে হচ্ছে। এই ভাইরাসের কোনও অ্যান্টি ভাইরাল হয় না, আমরা সাপোর্টিভ ম্যানেজমেন্ট করতে পারি কেবল। নির্দিষ্ট কোনও ওষুধই এর নেই। ’
সুমনা আরও জানালেন, অ্যাডেনো যেহেতু ছোঁয়াচে রোগ, তাই সতর্ক থাকতে হবে অনেক বেশি। মূল কথা হল, পরিচ্ছন্ন থাকা। বারবার নিজের হাত ধুতে হবে, বাচ্চার হাতও ধুয়ে দিতে হবে। হাঁচি-কাশি থেকে দূরে রাখতে হবে শিশুকে। শরীরে জলের অভাব যেন না হয়। শিশুর জ্বরজারি হলেই তাই ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন তিনি। কেননা ঝুঁকির চেয়ে সতর্কতা সবসময়ই অনেক ভালো!
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null