মাসিকের ওই দিনগুলোয় নারীর মন ভালো-খারাপ হওয়ার পিছনে থাকতে পারে হরমোনের ভূমিকাও

মাসিকের ওই দিনগুলোয় নারীর মন ভালো-খারাপ হওয়ার পিছনে থাকতে পারে হরমোনের ভূমিকাও

সুদেষ্ণার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে মেয়েদের সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না অনীশের। ছোটবেলা থেকে কেরিয়ারিস্ট অনীশের জীবনে বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। কলেজ জীবনটাও কেটেছিল কাঠখোট্টা। তাই অনীশ যখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্লেসমেন্ট পেল, তখন অনীশের মা-ই দায়িত্ব নিলেন ছেলেকে সংসারী করে তোলার। চাকরি পাওয়ার পর মা-বাবাকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুরে যায় অনীশ। সেখানেই প্লেনে সহযাত্রী সুদেষ্ণাকে পছন্দ হয় ওর মায়ের। ছেলের তো কখনই মন দেওয়া নেওয়াতে উৎসাহ ছিল না। তাই তাঁর চেষ্টাতেই কয়েক মাস পরে সুদেষ্ণা আর অনীশের বিয়ে হল। হোক না অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, অনীশ আর সুদেষ্ণা দিনদিন একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠল। একে অপরের সঙ্গে নিজেদের সমস্যা শেয়ার করতে কোনও বাধা নেই তাদের মধ্যে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই অনীশ লক্ষ্য করতে শুরু করল, মাঝে মাঝেই সুদেষ্ণা খুব রেগে যাচ্ছে, খাবার খাচ্ছে না সময় মতো, শুয়ে থাকছে বেশিরভাগ সময়। অনেকে অল্পেই রেগে যায়, সেটা অনীশ জানে। কিন্তু সুদেষ্ণা তো তেমনটা নয়, খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে ও। সবরকম পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিতে পারে। তা হলে এমন হঠাৎ হঠাৎ রাগ কেন?(Period hoyar age mood swing samlaben ki kore, Period-e meyeder mejej othanama kore keno, masiker somoy mood swing.PMS Emotions Mood Swings During Period in Bengali.)

 

অনীশ এ নিয়ে কথাও বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। এই রাগের সময় ও যেন নিজের মধ্যেই থাকে না। যেটা মন চায়, সেটাই করতে ভালোবাসে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর চার-পাঁচ দিন ধরে এই ঘটনা ঘটত, বাকি সময়টা আবার ঠিকঠাক নিয়মমতো চলত। অনীশ তাই এই নিয়ে বেশি ঘাঁটায়নি সুদেষ্ণাকে। ইতিমধ্যে বাড়ির সবাই চাইছে এবার একজন ছোট্ট সদস্য আসুক পরিবারে । অনীশ ঠিক করল এই বিষয়ে সে আগে একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবে। সেই মতো সুদেষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করল চিকিৎসকের সঙ্গে। সেখানেই কথা বলতে বলতে অনীশ সুদেষ্ণার হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলল, এমনকী রেগে গেলে কী কী করে তাও বলল। ডাক্তার পুরোটা শুনেই বললেন সুদেষ্ণার এই সমস্যা একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। একে পিএমএস বা প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রম(PMS, Premenstrual syndrome) বলে। ওর মতো আরও অনেকে মেয়েই এই সমস্যায় ভোগেন।

 

 

পিরিয়ডে মেয়েদের মুড বা মেজাজ এত ওঠানামা করে কেন? (Causes of PMS Emotions Mood Swings During Period)

আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়ই, পিএমএস এর মানে কী? সুদেষ্ণার এই রাগ হওয়া কি তবে কোনও গুরুতর সমস্যার লক্ষণ? চিকিৎসকের মতে, এটা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়, একেবারেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, পিরিয়ড শুরু হওয়ার কিছু দিন আগে থেকে অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই এরকম কিছু মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, মন খারাপ লাগে, এমনকী নানা বিষয়ে দুশ্চিন্তা হয়। একই কারণেই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

 

  • কখন হয়: পিরিয়ড শুরু হওয়ার ১৪-১৫ দিন আগে থেকে পিএমএসের লক্ষণগুলো দেখা দিতে থাকে। তবে লক্ষণগুলো পিরিয়ড শেষ হওয়া পর্যন্ত টানা চলতে থাকে তেমনটা কিন্তু নয়। মাঝে ছয়-সাতদিন কোনও রকম লক্ষণই হয়তো রইল না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে লক্ষণগুলো হয়তো আবার ফিরে এল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পিএমএস হলে অন্তত দুটো পর্বে তা চলবেই।

 

  • কেন এমন হয়: পিএমএস বা প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রম কেন হয়, বিশেষজ্ঞরা তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দায়ী করছেন স্ত্রী-হরমোনগুলোকেই। মেয়েদের শরীরে থাকা স্ত্রী-হরমোনের ক্ষরণ মাসের বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম পরিমাণে হয়। একটা পিরিয়ড শেষ হলে প্রধান ফিমেল হরমোন ইস্ট্রোজেনের ক্ষরণ অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে। ১৪-১৫ দিনের মাথায় তা পৌঁছে যায় তার সর্বোচ্চ মাত্রায়। এরপরেই তরতরিয়ে কমতে থাকে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ। আবার পরের পিরিয়ড শুরুর পর থেকে অল্প অল্প করে ক্ষরণ বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের এই উত্থান-পতনই প্রভাব ফেলে মেয়েদের মানসিক অবস্থায়। আর তা থেকেই পিএমএস-এর সমস্যা। এরই মধ্যে যদি বাড়িতে অফিসে অশান্তি চলতে থাকে, তবে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়ি ও বাইরের অশান্তি কিন্তু পিএমএসের কারণ কখনই নয়, কিন্তু এগুলোর প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে এই সমস্যা।

 

পিরিয়ডের শুরু হওয়ার আগে এমনিই এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম শারীরিক বা মানসিক লক্ষণ দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রেই পেটের পেশিতে টান, খেতে অনিচ্ছা, শরীরে অস্বস্তি বা মাথাধরা ইত্যাদি জানান দেয়, এবার পিরিয়ড শুরু হবে। এসবের মধ্যেও কী করে বুঝবেন পিএমএস-এর সমস্যায় আক্রান্ত কি না? বিশেষজ্ঞদের মত, হরমোনের তারতম্যের ফলে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। তার মধ্যে অন্তত চার থেকে পাঁচটি লক্ষণ কারও ক্ষেত্রে ফুটে উঠলে বুঝতে হবে, তিনি পিএমএস সমস্যায় আক্রান্ত। লক্ষণগুলো কী কী? দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।

 

#1. অবসাদ বা ডিপ্রেশন: ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনগুলোর ওঠানামার কারণে ডিপ্রেশন বা অবসাদ মনে চেপে বসতেই পারে, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পিএমএস-এ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের লক্ষণ প্রায়ই দেখা যায়। এই কারণে মনটা ভার হয়ে থাকে দিনের অধিকাংশ সময়। শুধু ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরন নয়, সিরোটোনিন হরমোনের মাত্রাও এই সময় কমে যায় বলেই, মন খারাপের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এসবের পাশাপাশি কাজের জায়গার স্ট্রেস আর বাড়িতে অশান্তি হলে তো সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।

 

#2. অ্যাংজাইটি: কাজ করতে গিয়ে কিছুতেই মন বসছে না, একটা অজানা ভয় চেপে ধরছে বারবার, কমে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। এ সবই উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটির লক্ষণ। আর পিএমএস-এ আক্রান্ত হলে এই অ্যাংজাইটিতে ভোগা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। পিরিয়ডের সময় ও তার আগেও এটা কিছুদিন থাকে। দিনের প্রায় সব কাজেই এই অ্যাংজাইটির প্রভাব দেখা যেতে পারে।

 

আরও পড়ুনঃ যন্ত্রণাদায়ক মাসিকের কারণ ও ঘরোয়া টোটকায় প্রতিকার

 

#3. নার্ভাস হয়ে পড়া: বাড়ি আর বাইরে, দুজায়গাতেই প্রচুর দায়িত্ব পালন করতে হয় মেয়েদের। অথচ কিছুদিন ধরে সব ক্ষেত্রেই যেন একটা নার্ভাসনেস অনুভব করছেন। আর প্রতিমাসেই এমনটা হয়েই চলেছে। এটাও কিন্তু পিএমএস-এর অন্যতম প্রধান লক্ষণ। পিএমএস-এর ফলে যেসব মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তাদের মধ্যে নার্ভাসনেস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ই থাকে।

 

#4. রেগে যাওয়া: পান থেকে চুন খসেছে কি খসেনি, রেগে আগুন হয়ে যাচ্ছেন মুহূর্তের মধ্যেই। খুব ছোট ছোট ব্যাপারেও মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আর এটা সব সময় যে হচ্ছে তা নয়, হচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট দিন ধরেই। বিশেষজ্ঞদের মত, পিএমএস-এ আক্রান্তদের মধ্যে পিরিয়ডের সময় এই লক্ষণ প্রায়ই ফুটে ওঠে।

 

#5. কান্নাকাটি: পিরিয়ড চলাকালীন পেটের পেশিতে টান পড়ায় এতই কষ্ট হচ্ছে যে আপনি মাঝে মাঝে কেঁদেই ফেলছেন। মন খারাপ থেকেও মাঝে মাঝে কান্না আসছে। মনে হচ্ছে কেঁদে মনটা একটু হালকা করে নিই। পিরিয়ডের সময় এমন ঘটনা কিন্তু পিএমএস-এর ইঙ্গিত দিতে পারে।

 

#6. ক্লান্তিভাব: পিরিয়ডের সময় এমনিই শরীর দুর্বল লাগে। কিন্তু পিএমএস-এর প্রভাবে আরও দুর্বল লাগতে পারে শরীর। এমনকী কাজ করতেও ইচ্ছা করে না।

 

#7. ঘুমের ব্যাঘাত: পিএমএস-এ আক্রান্ত হলে ঘুমের নিয়মেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। রাতে ঘুম কমে যাওয়া, দিনের বেলায় ঘুমোনো, এসব পিএমএস-এর স্বাভাবিক লক্ষণ।

 

 

উপরের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্তত চার-পাঁচটিও যদি পিরিয়ডের সময় দেখা যায় তবে বুঝতে হবে, এগুলো পিএমএস-এর ইঙ্গিত হলেও হতে পারে। কিন্তু কীভাবে এই সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞরাই বাতলে দিচ্ছেন এর বেশ কিছু উপায়

 

  • ব্যায়াম: খুব কঠিন ব্যায়াম নয়, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের  মতো সহজ ব্যায়াম করুন। সকালে পাড়ায় হাঁটতে বেরোন। দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন যা কিছু আপনার মনকে ভারী করে রেখেছে, সব দূর হবে ব্যায়ামেই। বিভিন্ন সমীক্ষাতেও দেখা গেছে ব্যায়াম মনকে শান্ত করে, দূর করে মন খারাপ।

 

  • খাওয়াদাওয়ায় বদল: খাওয়াদাওয়ার রুটিনেও কিন্তু বদল আনা জরুরি। সবরকম জাংকফুড বাদ দিতে হবে ডায়েট থেকে। এমনকী ক্যাফিন জাতীয় পানীয় বা অ্যালকোহলও একেবারে দূরে রাখতে হবে। বরং খেতে হবে দুধ, দইয়ের মতো ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। কারণ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।

 

  • আরাম করুন: গান শুনুন, বই পড়ুন বা পছন্দের হবি নিয়ে সময় কাটান। একমাত্র রিল্যাক্সেশনই পিএমএস-এর সময় অ্যাংজাইটি নার্ভাসনেস কমাতে পারে।

 

  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: উপরের পদ্ধতিগুলো মেনে চলার পরেও কোনও সুফল পাচ্ছেন না। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না কিছুতেই। তা হলে কিন্তু আর দেরি করা চলবে না। পিএমএস গুরুতর অবস্থায় চলে গেলে মেডিকেশন ছাড়া আর উপায় থাকে না। তাই এমন সময় ডাক্তারই কিন্তু ভরসা।

 

পিএমএস সম্পর্কে অনীশ তো দূরের কথা, সুদেষ্ণাও জানতো না। তাই পিএমএস-এর লক্ষণগুলো কী কী তাও ধরতে পারেনি সুদেষ্ণা। তবে ডাক্তারবাবুর পরামর্শে অল্পসময়েই সুস্থ হয়ে ওঠে সুদেষ্ণা। কিন্তু আপনি তো এখন পিএমএস-এর লক্ষণ, আর তা আটকানোর প্রাথমিক উপায়গুলো জানেন‌। তাই এবার থেকে সবসময় খেয়াল রাখুন নিজের স্বাস্থ্যের দিকে। কারণ সংসারে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তো আপনারই।

 

আরও পড়ুনঃ সতর্ক নন সঙ্গমে; কীভাবে আটকাবেন প্রেগন্যান্সি?

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null