সব্বাই বলে থাকেন, বাচ্চার মনের ভাবপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম তার কান্না। আমি যদি এখন এটা মানবো না বলে বেঁকে বসি, তা হলে কেমন হয়? কেমন হয় যদি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিই যে শুধু কান্না নয়, নানাবিধ অঙ্গভঙ্গী করেও বাচ্চা কথা বলতে চায় বা মনের ভাব বোঝায়; কেমন হয় বলো দেখি! না, বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখবো না মোটেই, অভিজ্ঞ মায়েদের আর চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণেই সামনে এসেছে বাচ্চাদের এই “গোপন ভাষা।” (Signs That Can Help You Understand Your Baby)
বাচ্চা যদি হাত মুঠো করে থাকে, তা হলে তার খিদে পায়। জানতে এটা? বা, গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ বার করছে, তার মানেই বা কী? এরকম তথ্যতেই ভরপুর আজকের প্রতিবেদন। বাচ্চাদের ওপর সাধারণ একটা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়েছে। বাচ্চার অঙ্গভঙ্গী বা বডি ল্যাঙ্গয়েজ, কান্নার রকমফের এবং গলার নানা আওয়াজের মাধ্যমে বাচ্চা কী বলতে চায় (Signs that Will Help You to Understand Your Baby Before They Can Speak), জানতে হলে পড়ে ফেলো প্রতিবেদন।
#1. বাচ্চার অঙ্গভঙ্গীই বুঝিয়ে দেবে ওর মনের কথা (Your Baby’s Movements)
আমরা না হয় কথা বলে পরিষ্কারভাবে নিজের চাহিদা, আবদার বা রাগ অন্য কাউকে জানাতে পারি। কিন্তু, ছোট্টগুলো? যারা কথা বলতেই শেখেনি তারাও কিন্তু ভাবপ্রকাশে কম যায় না। শুধু, পদ্ধতিটা অন্য। নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে বাচ্চা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। যেমন (Baby Signs & Language),
- হাত মুঠো করে রাখা: বাচ্চার খিদে পেয়েছে।
- হাতের মুঠো খুলে রাখা: বাচ্চার পেট ভর্তি, বেশ আরামে আছে ও।
- মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সমানে: ছোট্ট মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা মানে ভয়ের কোনও কারণ নেই। বাচ্চা নিজেই নিজেকে শান্ত করছে বা নতুন লোকজন এসেছে আশেপাশে তাদের দেখছে। আবার এও হতে পারে যে ওর ঘুম পেয়েছে।
- হঠাৎ দু’হাত ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা করা বা তিড়কে ওঠা: বাচ্চা হয়তো ঘুমোতে ঘুমোতে একটু ভয় পেয়ে গেছে। জেগে থাকা অবস্থায় আশেপাশে জোরে আওয়াজ হলে বাচ্চা ভয় পেয়ে তিড়কে ওঠে।
- নিজের কান ধরে টানা: জন্মের পর থেকে প্রত্যেকদিন বাচ্চা একটু করে বড় হয়। নিজের কান, নাকে হাত দেওয়া মানে খুদে উপলব্ধি করছে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তবে বাচ্চা যদি কানে হাত দিয়ে ক্রমাগত টানে বা কাঁদে; তা হলে কানে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিন্তু। দাঁত ওঠার সময়েও বাচ্চাদের কানে এই ধরনের ব্যথা হয়।
- পিঠ বাঁকানো: মায়ের কাছে দুধ খেতে খেতে পিঠ বাঁকানো মানে ওর পেট বেশ ভরে গেছে। আবার এই পিঠ বাঁকানো কিন্তু কলিকের জন্যও হতে পারে। বাচ্চার মুড খারাপ থাকলে বা ও খুব ক্লান্ত হয়ে থাকলেও বাচ্চা মাঝে মাঝে পিঠ বাঁকায়।
- পেটের দিকে পা তুলে আনা: পেটে গ্যাস হয়ে অস্বস্তি হলে বা কলিকের ব্যথা হলে বাচ্চা পা পেটের দিকে মুড়ে তুলে আনে।
- আড়মোড়া ভাঙা: আড়মোড়া ভাঙার অর্থ, শুয়ে শুয়ে খেলেই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেচারা। আবার একটু একটু ঘুম এলেও বাচ্চা এরকম করে।
হাত দিয়ে মুখ, নাক, চোখ ঘষা: খুব ঘুম পেয়েছে অথচ ঘুমনোর মতো পরিবেশ পাচ্ছে না বেচারি, একটু রেগে তো যাবেই! হাত দিয়ে বারবার নাক, চোখ ঘষা, একটু একটু কাঁদবো কাঁদবো ভাব এরকম হলে বাচ্চাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিন।
আরও পড়ুন: ছোট্ট শিশুর কথা বলতে শেখার সময়টায় কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা নয়!
#2. কান্নারও আছে রকমফের, খেয়াল করেছেন তো? (Your Baby’s Cry)
- খিদের জন্য কান্না: জোরে জোরে কাঁদবে, ঘ্যানঘেনে ভাবে কেঁদে যাবে। অস্থিরভাবে মাথা নাড়াবে ও মুখে নানারকম আওয়াজ করবে।
- “মা” কে ডাকার কান্না: এটা কিন্তু শুধুই কান্না নয়। মা’কে বা প্রিয়জনকে কাছে ডাকার একটা মাধ্যম। একটু করে কাঁদবে আবার চুপ হয়ে যাবে। কেউ কাছে না এলে আবার কাঁদবে।
- অস্বস্তির কান্না: কান্না শুনেই বুঝতে পারবেন যে বাচ্চার অস্বস্তি হচ্ছে কোথাও। ওর বিরক্ত লাগছে। থেমে থেমে কাঁদবে বাচ্চা। এরকম কেন করছে তার কারণ খুঁজে না পেলে ডায়াপারটাই একটু দেখে নিন না হয়।
- ব্যথার কারণে কান্না: একনাগাড়ে কাঁদবে বাচ্চা। কেঁদে ক্লান্ত হয়ে গেলে যেমন শোনায়; ওর কান্না শোনাবে অনেকটা ওরকম। ওর কান্না শুনে মনে হবে কাঁদতেও শক্তি নেই বেচারার, আটকে আটকে কাঁদবে।
- ঘুম পাওয়ার কান্না: নরম নরম ঘ্যানঘেনে কান্না, মাঝে হাই তোলা, চোখ চুলকানো থাকলে খুদের ঘুম পেয়েছে।
- থেমে থেমে কান্না: নিজের শরীরের নানা কাজকর্মের সাথে পরিচিত হওয়ার সময়েও বাচ্চার কান্না আসে। একটু নরম গলায়, বিরক্তির সাথে কাঁদে বাচ্চা।
- খারাপ মুডের কান্না: নতুন কোনও জায়গায় গিয়েছেন বা নতুন লোকজনের মাঝে; বাচ্চা কোনও কারণ ছাড়াই ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করলো। চোখে জল আছে কি নেই, একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। হয় ওর খুব বিরক্ত লাগছে বা আশেপাশের পরিবেশটা একদমই পছন্দ হয়নি ওর।
#3. বাচ্চার গলার আওয়াজে কীভাবে বুঝবেন ওর কথা (The Noises Your Baby Makes)
নানা ধরনের আওয়াজের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে অনেক কথা। মুখ থেকে যেসব দুর্বোধ্য আওয়াজ বার করে ছানার দল, তার মাধ্যমেও কিন্তু সে যোগাযোগ করতে চায় প্রিয়জনের সাথে।
গলার ভিতর থেকে উত্তেজনাপূর্ণ আওয়াজ (Squeals)-> কোনও কিছু দেখে উত্তেজিত হলে বা আনন্দ হলে বাচ্চা গলার ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ একরকম আওয়াজ বার করে। সাধারণ আওয়াজের থেকে এটা বেশ জোরালোই হয়ে থাকে। ধরুন, আপনি কোনও খেলনা দেখাচ্ছেন বা অঙ্গভঙ্গী করছেন, হঠাৎ পুঁচকে হাত-পা নেড়ে মুখে অমনি আওয়াজ করলো। তার মানে, আপনি যা করছেন, সেটা ওর ভারি পছন্দ হয়েছে।
- মুখ না খুলে গলার স্বর ভারি করা (Grunts )-> ১ বছর হওয়ার কয়েক মাস আগে থেকে বাচ্চা এইরকম আওয়াজ পটি করার সময় করতে শুরু করে। বাচ্চার বোর লাগলে বা বিরক্তি হলে অনেক সময় ওরকম ঠোঁট চেপে “হুম্মম হুম্মম” আওয়াজ করতে থাকে একটানা। আবার সে একটু বড় হয়েছে, পছন্দের কোনও খেলনা তার চাই, বা মা ঘরে ঢোকা মাত্র মায়ের কোলে চাপা চাই, এইরকম বিভিন্ন দাবি বুঝিয়েও বাচ্চা এই ধরনের আওয়াজ করে।
- কিছু একটা উচ্চারণ করা (Babbles)-> সাধারণত, বাচ্চার বয়স ৪-৬ মাস হলে বাচ্চা কিছু একটু অর্থপূর্ণ বলার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, সে চেষ্টা করে, আমাদের কানে কিন্তু সেটা মিষ্টি কতগুলো শব্দ হয়েই আসে। চারপাশে ভেসে বেড়ানো যে কথা বা শব্দ শিশু সারাদিন শুনছে, তার মধ্যেই ১-২ টি শব্দ সে উচ্চারণের চেষ্টায় থাকে। আমাদের কাছে তার কোনও মানে না থাকলেও শিশুর কাছে সেটা কিন্তু অনেক বড় গল্প।
- একটু আওয়াজ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া (Sighs)-> বাচ্চারাও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মাঝে মাঝেই ছাড়া। শিশু আনন্দ পেলেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আবার নিজেকে রিল্যাক্স করতে চাইলেও তাই।
- গরগর আওয়াজ করা (Growls)-> ৬ মাস বয়সের মধ্যেই বাচ্চারা গরগর করে একধরনের আওয়াজ করতে থাকে। গরগর আওয়াজ করা মানে আপনার বাচ্চা বদমেজাজি হবে, এরকম কিন্তু ভাববেন না। বাচ্চারা যখন গরগর আওয়াজ করে, তাদের গলার মধ্যে একটা অনুভূতি হয় এবং সেটা ওদের বেশ পছন্দের। একটু বড় হওয়ার পরে কিন্তু বিরক্ত হলে বা কোনও কাজ তার অপছন্দ হলে এই রকম আওয়াজ করে।
- খিলখিল করে হাসা (Chuckles)-> চারমাসের আশেপাশে বয়স হলে বাচ্চা হাসতে শেখে। একটু মজার কাজকর্ম করুন না, বাচ্চা হাসবে ভুঁড়ি দুলিয়ে। ওর হাঁটুতে একটু সুরসুরি দিয়ে দেওয়াই হোক বা পেটে নাক দিয়ে ঘষে দেওয়া হোক, বাচ্চা খুব মজা পায় এবং খিলখিল করে হাসে।
খুদের সবচেয়ে কাছের মানুষ তার মা। বাচ্চার হাবভাব একটু ভালো করে কয়েকদিন লক্ষ্য করলেই মা বুঝে যায় সে কী চায়! আমরা সাধারণ একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম নতুন মায়েদের সাহায্যার্থে। কোনও কোনও বাচ্চার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয় একেবারেই। প্রতিবেদন থেকে একটা আন্দাজ নিয়ে রাখুন, তারপরে নিজের কুচোটির ভাবসাব নজরে রাখুন, কথা ফোটার আগেই দেখবেন মায়ে ছায়ে ভাব হবে জব্বর। (Signs That Can Help You Understand Your Baby)
আরও পড়ুন: ১ বছর পর্যন্ত প্রত্যেক মাস অনুযায়ী শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ
একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
null
null