আপনার খোকা বা খুকু ওবেসিটি-তে ভুগছে না তো? উপসর্গ বুঝে সতর্ক হন আজ থেকেই!

আপনার খোকা বা খুকু ওবেসিটি-তে ভুগছে না তো? উপসর্গ বুঝে সতর্ক হন আজ থেকেই!

ছোট্ট পিকলুকে সুপ্রীতি সবসময় চোখে চোখে রাখে। পিকলুই সুপ্রীতির একমাত্র সন্তান। তাই মা হিসেবে ও পিকলুকে নিয়ে একটু বেশিই কনসার্ন। ওর ছোট্ট সোনার বয়স এখন দশ মাস। সুপ্রীতি একজন ওয়ার্কিং ওম্যান হলেও গত দশ মাস বাড়িতে বসে সব কিছু নিজে হাতে সামলেছে সে। কিন্তু গত মাস থেকে পিকলুর এক সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ওর ওজন স্বাভাবিক গড় ওজনের তুলনায় বেশি। অথচ উচ্চতা ঠিকঠাক রয়েছে। পিকলুর চিকিৎসক বলেছিলেন, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, শুধু একটা ডায়েট চার্ট মেনে চলতে হবে ওর ছোট্ট সোনাকে। এখন সব খাবার সেই চার্ট মেনেই তৈরি হয়। কিন্তু ওজন এখনও বেশির দিকেই (Baby fat, When Is It Cause for Concern)। পিকলুর মায়ের চিন্তাও তাই কমছে না।

পিকলুর মতো আপনার ছোট্ট সোনাও কি ওজন বৃদ্ধির সমস্যায় ভুগছে? বয়স একবছর হোক বা দুই বছর, ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এখন অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তাই মায়েদের জন্য শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই সাজিয়ে দিচ্ছেন বেশ কিছু গাইডলাইন। চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই গাইডলাইন।

গাইডলাইন দেখার আগে আপনার সোনামণির ওজন বাড়ছে কি না, তা তো জানতে হবে। তবে এর জন্য এখন আর চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতেই কয়েকটি জিনিসের মাধ্যমে আপনি জেনে নিতে পারেন আপনার একরত্তির ওজন আর উচ্চতা স্বাভাবিক আছে কি না (Is Your Baby Too Fat?)। জেনে নেওয়া যাক কীভাবে তা সম্ভব।

 

  • গ্ৰোথ চার্ট: ওজন বাড়ছে না কমছে? এটা মাপতে হবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে। শিশুদের বৃদ্ধি মাপতে মেডিক্যাল সায়েন্স তৈরি করেছে ওজন, উচ্চতা আর মাথার পরিধির একটি চার্ট, যার পোশাকি নাম গ্ৰোথ চার্ট । একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রতিমাসে শিশুর ওজন, উচ্চতা ইত্যাদির বৃদ্ধি কেমন হওয়া উচিত, তা বলে দেয় এই চার্ট।

 

  • উচ্চতাও মাপুন: চিকিৎসক ওজনের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতাও নজরে রাখতে বলছেন। এর কারণ কী? আসলে, শুধু ওজন দেখেই বলে দেওয়া যায় না, সে অতিরিক্ত রোগ নাকি সে ওবেসিটিতে ভুগছে। শিশুর ওজন ও উচ্চতা এই দুইয়ের মাপ নিয়ে অঙ্ক কষে বের করতে হয় বেসাল মেটাবলিক রেট (Basal Metabolic Rate)। সেই রেট একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জের বেশি হলে তখনই বলা যায় শিশুর ওজন বেড়েছে। (Chubby Babies) চিকিৎসকও ঠিক এই কাজটি করেন।

 

  • কীভাবে মাপবেন: শিশুর ওজন মাপার সময় ছোট্ট সোনাকে খালি গায়ে একটি ওজনযন্ত্রে শোওয়াতে হবে। জামাকাপড় পরানো থাকলে তার মাপও বাচ্চার ওজনে জুড়ে যায়। ওজনযন্ত্র ঠিকঠাক মাপ দিচ্ছে কি না তাও দেখে নেওয়া দরকার। উচ্চতা মাপার জন্য শিশুকে কোনও সমতল এলাকায় শুইয়ে দিন। এক্ষেত্রে মেঝেতে শোওয়ালে সবচেয়ে ভালো। এরপর একটি ফিতে ওর পাশে মেঝেতে ফেলে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মাপ নিন‌।

Baby growth chart in Bengali

 

 

ওজন বাড়লেই কি তা দুশ্চিন্তার বিষয় ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা কখনই নয়। বরং ওজন বাড়লে শিশুর কয়েকটি পরিবর্তনের দিকে নজর রাখতে হবে। সেই পরিবর্তনগুলো দেখে বোঝা সম্ভব, বিষয়টা দুশ্চিন্তার কি না।

নাদুসনুদুস, গোলগাল ছানা- মিষ্টি তো মানলাম। কিন্তু চিন্তার কারণ কোথায়? (Baby Fat- Cute? Or Cause For Concern?)

 

  • প্রতিমাসেই ওজন বেশি: ছোট্ট সোনার ওজন গ্ৰোথ চার্টে থাকা স্বাভাবিক রেঞ্জ ছাড়িয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, পরপর দু’-তিন মাস ধরে ওর ওজন স্বাভাবিকের সীমা ছাড়িয়ে উপরের দিকেই রয়েছে। এমনটা হলে তা চিন্তার বিষয়। (Baby fat, When is it cause for concern)

 

  • চলাফেরা কম: বাচ্চার ওজন তো বাড়ছেই, পাশাপাশি কমে গিয়েছে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে খেলা। বাচ্চার মধ্যে এমন পরিবর্তন এলে তা চিন্তার বিষয়।

 

  • শারীরিক পরিবর্তন: ছোট্ট সোনার ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশি। কিন্তু এর পাশাপাশি, মাঝে মাঝেই সে ঝিমিয়ে পড়ছে, নির্দিষ্ট সময়ের থেকে অনেকটা বেশি ঘুমোচ্ছে, বা মাঝে মাঝেই তার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার কারণেও ওর ওজন বাড়তে পারে।

 

আরও পড়ুন: বাচ্চার ওজন বাড়াতে বেশি খাওয়াচ্ছেন? সাবধান!

 

ছোট্ট সোনার ওজন বেড়ে যাচ্ছে বলে দুশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। অথচ কেন ওজন বাড়ছে, সেটা বুঝতে পারছেন না। শিশুর ওজন বৃদ্ধির জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কারণকে দায়ী করেন। এবার সেগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। (Childhood obesity- Symptoms and Causes )

 

#1. চলাফেরা কম: ছোট্ট শিশু দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ তার সব খেলাই এক জায়গায় বসে। দশ মাসের একরত্তি কিছু না-বুঝেই ঠায় তাকিয়ে থাকে ফোন বা টিভির স্ক্রিনের দিকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের মাধ্যমে শিশুর শরীরে যে ক্যালোরি প্রবেশ করছে, তার একটি অংশ নিয়মিত খরচ হওয়া উচিত। তা না হলে ছোট্ট শরীরে জমতে থাকবে ফ্যাট (Overweight Baby)। আর তা থেকেই বাড়তে পারে একরত্তির ওজন।

 

#2. জিনগত কারণ: অন্য কোনও সমস্যা না থাকলেও দিনদিন ওজন বাড়ছে ছোট্ট সোনার। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন রাখছেন বাবা-মায়ের কাছেই। কোনওভাবে ছোট্ট সোনার বাবা-মায়ের ওজন বেশি নয় তো? অনেকসময় দেখা যায় বাবা-মায়ের ওজন বেশি হলে জিনগত কারণে সন্তানও একই ধাঁচ পেয়ে যায়।

 

#3. শারীরিক সমস্যা: ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট সোনার মধ্যে কি আর কোনও পরিবর্তন আসছে? সে কি ঝিমিয়ে পড়ছে, বা সর্দিতে ভুগছে ? এমনটাই জানতে চান অনেক চিকিৎসক। এর কারণ ওজন বাড়ার পিছনে থাকতে পারে শারীরিক সমস্যাও। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, অ্যাসমা, ডিপ্রেশন বা হার্টের অসুখ ইত্যাদি থেকেও একরত্তির ওজন বেড়ে যেতে পারে। (Obesity in Children)

 

 

ওবেসিটি-র প্রবণতা যদি ধরেই নেয়, কীভাবে যত্ন নেবেন ছোট্ট বাচ্চার? (Treatments for Childhood Obesity in Children)

নির্দিষ্ট রেঞ্জ ছাড়িয়ে ওজন বেড়ে গেলে দুশ্চিন্তাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু একরত্তির কয়েকটি বিষয়ে যদি খেয়াল রাখা যায়, তবে সহজেই তার ওজনের অতিরিক্ত বাড়বাড়ন্ত আটকানো সম্ভব। সেগুলো নিয়েই বিস্তারিত বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

  • ডিজিটাল মিডিয়া বন্ধ: বাচ্চাকে খাওয়ানো থেকে ঘুম পাড়ানো সবক্ষেত্রেই তার টিভি চাই বা ফোনের ভিডিও চাই ? দিনের অধিকাংশ সময় ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে তার চোখ সরছে না? এই অভ্যাস শিশুর পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাওয়ানোর সময় হাজার বায়না করলেও ডিজিটাল মিডিয়ায় ভুলিয়ে খাওয়ানো একদম ঠিক নয়। বিষয়টায় তার এমন নেশা তৈরি হয়ে যেতে পারে, সে নিজের খেলা ফেলে সারাক্ষণ এই জিনিসগুলো নিয়ে কাটাতে পারে। ফলে তার ওজন বাড়তে থাকবে।

 

  • শক্ত খাবার নয়: বাচ্চার বাবা-মা ওবেসিটির সমস্যায় ভোগেন। অথবা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ওবেসিটির ধাঁচ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাচ্চার ছোট থেকেই ওবেসিটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রথম ছয় মাস কোনওভাবেই শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ানো যাবে না (Infant Obesity Causes)। এমনটাই পরামর্শ দেন শিশু চিকিৎসকরা।

 

  • দৌড়াদৌড়ি করান: বসে বসে খেলতেই ছোট্ট সোনার বেশি ভালো লাগে? কিন্তু এভাবে যে ওর ওজন বেড়ে যাচ্ছে। তাই ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি হয়, এমন খেলায় তাকে উৎসাহ দিন। আপনি নিজেও ওর সঙ্গে খেলায় যোগ দিতে পারেন। একটা বল গড়িয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে আসতে দিন। অথবা রোবট ইঁদুরকে দৌড়ে ধরে আনতে বলুন। অ্যাক্টিভিটি বেশি হলে শরীরের ক্যালোরি সহজেই ঝরে যায়।

 

  • প্রেগন্যান্সির সময় ওজন: প্রেগন্যান্সির সময় মায়ের ওজন কীভাবে বাড়ছে, তা থেকেই সন্তানের ওজন আন্দাজ করা যায়‌। তাই প্রেগন্যান্সির সময় নজর রাখুন আপনার ওজনে। কোনওরকম অস্বাভাবিকতা দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন (When Do Babies Get Chubby)। ওজন যাতে না-বাড়ে তার জন্য ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলুন।

 

  • স্তন্যপান করান: ব্রেস্ট মিল্ক না ফর্মুলা ফিডিং? অনেক মায়েরাই এই নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাচ্চাকে ফর্মুলা ফিডিং করালে ওবেসিটির আশঙ্কা বাড়ে। তাই সন্তানের ওজন নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে রাখতে স্তনদুগ্ধই সবচেয়ে উপযুক্ত। এমনকী প্রথম ছয় মাস শুধু স্তনদুগ্ধই খাওয়ানোই উচিত।

 

  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: অনেক সময় দেখা যায়, অ্যাসমা, ডিপ্রেশন বা হৃদযন্ত্রের রোগ ইত্যাদি থেকে শিশুর ওবেসিটির সমস্যা দেখা দিয়েছে । এসব ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ এক্ষেত্রে মেডিকেল ট্রিটমেন্টই ওকে সুস্থ করে তুলতে পারে।

 

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ডায়েট মেনে চলায় পিকলুর ওজন আগের মতো স্বাভাবিক রেঞ্জে ফিরে এসেছে। তবে সময় লেগেছিল দু’মাস (Baby Fat)। শিশুদের ক্ষেত্রে ওবেসিটির সমস্যা আরও নানারকম রোগ ডেকে আনতে পারে। তাই মাকে নজর রাখতেই হবে বাচ্চার ওজনের দিকে। আর মাকে সাহায্য করতে তো রইলই এই গাইডলাইন। (Baby fat, When Is It Cause for Concern)

 

আরও পড়ুন : আর দুশ্চিন্তা নয়, নিয়ম মানলেই নাদুসনুদুস হবে কোলের ছানা!

 

একজন মা হয়ে অন্য মায়েদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান? মায়েদের কমিউনিটির একজন অংশীদার  হয়ে যান। এখানে ক্লিক করুন, আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

null

null